শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৭

বাল্য বিবাহের বিরোদ্ধে নারী সংঘটন,তারা কী নারীর পক্ষে?না অনৈতিকতার পক্ষে?

কালচার : বাল্য-বিবাহ
সম্প্রতি ‘বাল্য-বিবাহ’ প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে আলোচনায়
এসেছে। গত ২৪ নভেম্বর সরকার বিয়ের জন্য মেয়েদের
ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স
হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন’ অনুমোদন
দিয়েছে। বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ নিয়ে এবং
বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের
সুযোগ রাখা আছে। (দৈনিক প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬)
শেষ পৃষ্ঠা) এই বিশেষ প্রেক্ষাপটের অবকাশটুকুর বিরুদ্ধেও
নারীবাদী সংগঠনগুলোকে সরব হতে দেখা গিয়েছিল। পরে
নানা কারণে তারা নীরব হয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে
শান্তভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। মুসলিম হিসেবে আমাদের
প্রথম কর্তব্য, এ বিষয়ে ইসলামী বিধান ও তার যথার্থতা সম্পর্কে
সচেতন হওয়া। এ সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আপাতত তিনটি বিষয়ে কিছু কথা
বলার ইচ্ছা রাখি। এক. কুরআন-সুন্নাহর বিধানের আলোকে বিয়ের
বয়স। দুই. কুরআনের বিধানের যৌক্তিকতা ও যথার্থতা এবং তিন. অন্যান্য
মতামতের পর্যালোচনা।
ছেলে-মেয়ের বিয়ের বয়স সম্পর্কে ইসলামী নীতি ও
বিধানের সারকথা হচ্ছে, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে, এমনকি
সাবালক হওয়ার আগেও মেয়েকে বিয়ে দেয়ার অবকাশ
রয়েছে; তবে বিনা কারণে অতি অল্প বয়সে ছেলে-
মেয়ের বিয়ে শাদীকে শরীয়ত উৎসাহিত করে না।
এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের সূরা তালাক (সূরা নং ৬৫)-এর ৪ নং
আয়াতটি প্রাসঙ্গিক। ইরশাদ হয়েছেÑ
ﻭَ ﺍﻟّٰٓـِٔﯽْ ﯾَﻯِٕﺴْﻦَ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤَﺤِﯿْﺾِ ﻣِﻦْ ﻧِّﺴَﺎٓﻯِٕﻜُﻢْ ﺍِﻥِ ﺍﺭْﺗَﺒْﺘُﻢْ ﻓَﻌِﺪَّﺗُﻬُﻦَّ ﺛَﻠٰﺜَﺔُ ﺍَﺷْﻬُﺮٍ ﻭَّ ﺍﻟّٰٓـِٔﯽْ ﻟَﻢْ
ﯾَﺤِﻀْﻦَ ﻭَ ﺍُﻭﻟَﺎﺕُ ﺍﻟْﺎَﺣْﻤَﺎﻝِ ﺍَﺟَﻠُﻬُﻦَّ ﺍَﻥْ ﯾَّﻀَﻌْﻦَ ﺣَﻤْﻠَﻬُﻦَّ ﻭَ ﻣَﻦْ ﯾَّﺘَّﻖِ ﺍﻟﻠﻪَ ﯾَﺠْﻌَﻞْ ﻟَّﻪٗ ﻣِﻦْ
ﺍَﻣْﺮِﻩٖ ﯾُﺴْﺮًﺍ .
তোমাদের যে সকল নারীর আর ঋতুমতী হওয়ার আশা নেই
তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দত
হবে তিনমাস, এবং যারা এখনো রজঃস্বলা হয়নি।...Ñসূরা তালাক (৬৫) : ৪
আয়াতের উদ্ধৃত অংশে তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত উল্লেখিত
হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তালাকপ্রাপ্তা নারী যার বয়স হওয়ার
কারণে ঋতু¯্রাব বন্ধ হয়েছে এবং যার প্রাপ্তবয়স্কা না হওয়ার
কারণে ঋতু শুরুই হয়নি, উভয়ের ইদ্দত তিন (চান্দ্র) মাস। অর্থাৎ
উদ্ধৃত আয়াত প্রমাণ করছে যে, ঋতুমতী হওয়ার আগেও একটি
মেয়ের বিয়ে হতে পারে এবং তালাকও হতে পারে।
নবী-যুগে অল্প বয়সে বিয়ের একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। স্বয়ং
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা রা.-কে যখন
বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল ছয় বা সাত বছর। রোখসোতির
সময় বয়স ছিল আট বা নয়। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম) আর
এ বিষয়ে উম্মাহর ফকীহ ও মুজতাহিদগণের ইজমাও রয়েছে।
(আহকামুল কুরআন)
সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের ভিত্তিতে এই বৈধতা ও
অবকাশ প্রমাণিত। তবে আবারও বলছি ইসলামে সাধারণ অবস্থায়
অপরিণত বয়সের বিয়েকে উৎসাহিত করা হয়নি। প্রতিবেশী নানা
ধর্ম ও মতবাদের সাথে ইসলামের পার্থক্য এখানেই। ইসলাম
বাল্য-বিবাহকে উৎসাহিত বা নিয়মে পরিণত করেনি আবার সর্বাবস্থায়
চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধও করেনি।
ইসলামের এই প্রশস্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ বিধানের যথার্থতা অতি
স্পষ্ট। বিচিত্র প্রয়োজন ও সংকটের ক্ষেত্রেও এ বিধান
পালনযোগ্য। দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে একটি বাস্তব
প্রতিনিধিত্বকারী ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরা যায়।
৬ ডিসেম্বর ২০১৬-এর দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘বিয়ের বয়স’
শীর্ষক নিবন্ধে একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। যশোরের
নাদিরা বেগমের চার মেয়ে। তার স্বামী সাবেক সেনাসদস্য।
প্রতিবেশী কয়েকটি প্রভাবশালী পরিবারের লোকজন নাদিরা
বেগমের সম্পত্তি দখল করতে চায়। কয়েকবার তাদের
বাড়ীতে হামলাও হয়েছে। এই সন্ত্রাসী লোকজনের
ক্ষতির আশংকায় তারা তাদের চার মেয়েকেই আঠারো বছর বয়স
হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়েছেন। নাদিরার মেয়েরা মহিলা
আইনজীবী সমিতির নারী নেত্রীদের সাথে কথাও
বলেছিলেন কিন্তু তারা ক্ষমতা নেই, পুলিশ নেই ইত্যাদি নানা কথা
বলে এড়িয়ে গেছেন।
তো এধরনের সংকটগুলো সামনে নিয়ে বাস্তবমুখী চিন্তা
করলে ইসলামী বিধানের যথার্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গাজীপুরের আরেকটি ঘটনা বেশ
আলোচিত হয়েছে। ঘটনার সারসংক্ষেপ হল, নবম শ্রেণীতে
অধ্যয়নরত দুটি ছেলে-মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক
হয়। ছেলেটির বয়স সতের, মেয়েটির পনের। বিষয়টি জানাজানি
হওয়ার পর দুই পরিবার পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে এদের বিয়ের
আয়োজন করে। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে এমন অবস্থায় এক
কলেজছাত্রী পুলিশ এনে বিয়েটি ভেঙ্গে দেয়।
এই ঘটনাটিকে একশ্রেণীর মিডিয়া খুব ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে
প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে এবং ঐ কলেজছাত্রীর
পদক্ষেপকে একটি ‘সাহসী’ ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ ও ‘যথার্থ’ পদক্ষেপ
হিসেবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে। অথচ খুব কম করে
বললেও অন্তত দুটি প্রশ্ন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম
প্রশ্নটি হচ্ছে, যেখানে ছেলে-মেয়ে নিজেও সম্মত, উভয়
পরিবারের অভিভাবকেরাও সম্মত, শুধু সম্মতই নয় তারা একে
প্রয়োজনও মনে করেছেন, আর বাস্তবেও তা প্রয়োজন,
সেখানে বাইরের এক কলেজ পড়–য়া মেয়ের মতামত
কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এই ছেলে-মেয়ের
বাস্তব প্রয়োজন কি এদের নিজেদের চেয়ে এবং এদের
অভিভাবকদের চেয়েও ঐ বাইরের মেয়েটি বেশি বুঝবে? শুধু
মতামতের দিক থেকে চিন্তা করলেও তো এ ঘটনায় একটি মাত্র
বাইরের মেয়ের মত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুটি পরিবারের
সম্মিলিত মতামতের উপর। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, দুটি ছেলে-
মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর বৈধ উপায়ে তাদের
মেলামেশাকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হল। ফলে অবৈধ উপায়ে
মেলামেশা ছাড়া এদের আর কোনো উপায় রইল না। বস্তুত
নারীবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ হতে বিশেষ আইনের
বিরোধিতার বাস্তব অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বৈধ মেলামেশাকে কঠিন করে
তোলা এবং বাস্তব সংকটে ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মা-
বাবাকে উপায়হীন অবস্থার মুখোমুখি করা।
এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবসম্মত ও
সুবিবেচনাপ্রসূত। তিনি বলেছেনÑ ‘বাল্য-বিবাহ নিয়ে ঘাবড়ানোর
কিছু নেই। আমাদের আর্থ-সামাজিক বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
যারা বিরোধিতা করছে সমাজের প্রতি তাদের দায়-দায়িত্ব কম। কারণ
তারা এনজিও করে পয়সা কামায় কিন্তু দায়িত্বটা নেয় না।’ তিনি আরো
বলেন, ‘বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই বাল্য-বিবাহ আইনটি করেছি।
গ্রামের পারিবারিক মূল্যবোধ ও সমস্যা সম্পর্কে তাঁদের
কোনো ধারণা নেই। যে কারণে তাদের অনেক বড় বড় কথা।...
আইনে কোনো সমস্যা থাকলে সেখান থেকে বের হওয়ার
সুযোগ দিতে হবে। না হলে সমাজে অনেক বড় বিপর্যয়
নেমে আসতে পারে। (দৈনিক প্রথম আলো ৮ ডিসেম্বর
২০১৬, শেষ পৃষ্ঠা)
বলা হচ্ছে, বাল্য-বিবাহ (অর্থাৎ আঠারোর আগে বিয়ের) অনুমতি
দেয়া হলে মেয়েদের উপর পারিবারিক সহিংসতা বাড়বে। অর্থাৎ
এদের মতে আঠারো সংখ্যাটি এমন এক কারিশম্যাটিক সংখ্যা যে, তা
পূরণ করা মাত্র সকল পারিবারিক সহিংসতা কর্পূরের মতো উবে
যাবে। অথচ বর্তমানে পরিবারিক সহিংসতার দৃষ্টান্তগুলোর সিংহ-ভাগই
এমন যাতে সহিংসতাকারী ও সহিংসতার শিকার উভয়েরই বয়স
আঠারোর উপরে। সুতরাং যুক্তি ও বাস্তবতার বিচারেও এগুলো
খুবই হাস্যকর কথা। এই সহজ কথা তো একজন সাধারণ মানুষও
বোঝেন যে, পারিবারিক সহিংসতাসহ সবরকমের যুলুম-অত্যাচার দূর
করার উপায় হচ্ছে মনুষ্যত্ব ও মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ এবং
আইনের যথার্থ প্রয়োগ। সুতরাং একদিকে ব্যাপক ঈমানী ও
দাওয়াতী তৎপরতা অন্যদিকে যথার্থ আইন ও তার প্রয়োগের
মাধ্যমেই এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
সবশেষে কোনোরূপ অবকাশ ছাড়া বিশেষ কোনো
বয়সকে বিয়ের বয়স সাব্যস্ত করা হলে যেসব কারণে তা
প্রত্যাখ্যাত হবে তা হচ্ছেÑ
এক. সরাসরি কুরআন সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা প্রমাণিত
ইসলামী বিধানের বিরোধী হওয়া।
দুই. দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আকিদা-বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও
সংস্কৃতির পরিপন্থী হওয়া।
তিন. বাস্তব সংকট ও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করা।
চার. আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত
ও সামাজিক সম্মানের জন্য হুমকি হওয়া।
পাঁচ. মিথ্যা ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটা।
ছয়. নৈতিক অবক্ষয় ও চরিত্রহীনতার বিস্তারে সহায়ক হওয়া ইত্যাদি।
সুতরাং এ ধরনের আইন প্রণয়নের কোনো অবকাশ নেই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন